অনলাইন ডেস্ক:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী যেন খোদ আওয়ামী লীগ। দলের ছাড় পেয়ে ঘরের ছেলেরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এখন স্বতন্ত্রের সংখ্যাধিক্যই অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছে। কারণ দলের মাঠ পর্যায়ে বার্তাটি পরিষ্কার হয়নি।
আবার আওয়ামী লীগের শরিক ও মিত্র দলগুলোর মধ্যেও স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে অস্বস্তি আছে, বিশেষ করে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ানো আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে শরিক দলের অনেক প্রার্থী উদ্বিগ্ন।
এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন গতকাল স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছে। ফলে এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এখন পর্যন্ত বেশি দৃষ্টি কাড়ছেন বলা যায়। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়ে যাঁরা নৌকা পাননি, তাঁদের একটি বড় অংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
নির্বাচনী প্রদীপের আলোয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা
দলের মনোনয়ন না পাওয়া বর্তমান ৭১ সংসদ সদস্যের মধ্যে ৬১ জনও আছেন এই তালিকায়। এত দিন এ বিষয়ে এক ধরনের ছাড় দিয়ে রাখা হলেও আস্তে আস্তে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বরের পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটিতে রয়েছেন এমন প্রার্থীদের অনেককে নির্বাচন থেকে সরে আসার নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে। জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলো কোন পথে হাঁটে, তা দেখেই মূলত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
আবার আওয়ামী লীগের মধ্যে এমন আলোচনাও আছে যে ভোটের মাঠে যেসব দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাঁদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে আনা সহজ হবে কি? আরেকটি শঙ্কার জায়গা হচ্ছে, এসব প্রার্থীর সমর্থকরা প্রচারণা বা ভোটের দিন নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কি না?
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বলা আছে, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হলে দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা যাবে। তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য বলেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচনে অংশে নিয়ে বহিষ্কার হওয়ার নজির যেমন আছে, তেমনি বিজয়ী হওয়ার পর দলে জায়গা পাওয়ার ঘটনাও অনেক। শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা এখনই বলা কঠিন।
দ্বাদশ নির্বাচনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৯টি দল অংশ নিচ্ছে। নির্বাচনে দুই হাজার ৭১৩ প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
আওয়ামী লীগ থেকে ৩০৪ জন মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এক হাজার ৯৬৪ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মনোনীত। অন্য ৭৪৭ জন স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী মোট প্রার্থীর প্রায় ২৮ শতাংশ।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা বলেন, এই সময়ের মধ্যে কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা হচ্ছে কি না, সেটা দেখতে হবে। যদি স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকে, তাহলে তো সমস্যা নেই। সবাই নির্বাচন করবে। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হলে দলীয় স্বতন্ত্রদের বসে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হবে। না মানলে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভাবনায় শরিকরা, অধিক স্বতন্ত্রের বিপক্ষে কেন্দ্রীয় কমিটি
আওয়ামী লীগের শক্তিশালী বিরোধী প্রার্থীদের নিয়ে চিন্তিত জোটের শরিকরাও। জোটের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নৌকা প্রতীক নিয়ে শরিকরা যেসব আসনে নির্বাচন করবেন, সেখানে অন্য দলের প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগের যেন স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকেন, সেদিকে আওয়ামী লীগের দৃষ্টি চান তাঁরা।
১৪ দলীয় জোটের নেতা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকে দলীয় বিদ্রোহীদের নিয়ে আলোচনা হবে। আওয়ামী লীগ ঘরের স্বতন্ত্রদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে, সেটা জানতে চাওয়া হবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ‘অধিক হারে স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে সেটা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আর সংঘর্ষ হবে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর। আমরা চাই অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন।’
তৃণমূলের কর্মীরা বিভ্রান্তিতে
কুষ্টিয়া-২ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন ছাড়া বাকি সব আসনেই দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ২২৯টি আসনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট করার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগের ৪৫৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
বরিশাল-৬ ও ময়মনসিংহ-৩ আসনে সবচেয়ে বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের। এই দুই আসনে আটজন করে প্রার্থী ভোটে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর বাইরে মেহেরপুর-২ আসনে সাতজন, নোয়াখালী-২, নওগাঁ-২ ও নওগাঁ-৬ আসনে ছয়জন করে এবং নোয়াখালী-৫, সাতক্ষীরা-১, চুয়াডাঙ্গা-২, কুড়িগ্রাম-৪, সিরাজগঞ্জ-৩, নীলফামারী-৩ ও মানিকগঞ্জ-২ আসনে পাঁচজন করে স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন।
এমন পরিস্থতিতে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের কর্মীরা কার পক্ষে ভোটের মাঠে কাজ করবেন, তা নিতে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কর্মীরা দীর্ঘদিন যাঁদের রাজনীতি করেছেন এখন তাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী। আবার দলের নিজস্ব প্রার্থীও আছেন।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম বলেন, ‘এখনো কেন্দ্র থেকে কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি। কার পক্ষে কাজ করতে হবে, এমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে আমরা নৌকার পক্ষে কাজ করছি। কিন্তু কেউ যদি স্বতন্ত্রের পক্ষে কাজ করে তাকে তো জোর করা যাবে না। তারাও আওয়ামী লীগেরই লোক।’
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসির নির্দেশ
দলীয় প্রার্থীদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল ইসি সচিবালয় থেকে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘এটা পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের ও আমাদের রিটার্নিং অফিসারদের বলেছি। জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব এসেছিলেন, সব বিষয়ে তাঁদের বার্তা দেওয়া হয়েছে। কেউ যেন নিরাপত্তার ঘাটতিতে না ভোগেন। এর পরও যদি কারো গাফিলতিতে কিছু হয়, তাঁর বিরুদ্ধে ইসি খুব শক্ত ব্যবস্থা নেবে।’ তিনি বলেন, সব প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় নির্বাচন কমিশন।